জাগো বন্দর ২৪.নিউজ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। প্রাণ হারান ৩৪ জন। সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। সময়ের মতো সময় কেটেছে। কিন্তু স্বজন হারানোর ক্ষততে প্রলেপ পড়েনি। এখনো শোক ভুলতে পারেননি নিতহদের স্বজনরা।
কান্না থামেনি সিফাতের বাবা
‘আমার বাবা অনেক ভাল ছিল। আমাকে কোনো কাজ করতে দিতো না। আমাকে মা না ‘মাদার’ বলে ডাকতো। আমাকে বলতো তুমি চিন্তা করো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসারের অভাব ঘুচানোর জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলা। কিন্তু তার আর চাকরি আর করা হলো না’-এভাবেই বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদ বিস্ফোরণে নিহত সিফাতের মা মঞ্জু বেগম। ছেলের শোকে তিনি পাগলপ্রায়।
তিনি আরও বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলো সিফাত। আমাদের তেমন টাকা পয়সা ছিল না। তাই তার নানার বাড়ি থেকে ১০ হাজার টাকা এনেছিলো। কিন্তু সেই টাকা রয়েই গেলো, সিফাতের কলেজে যাওয়া হলো না। নামাজ পড়ার জন্য না খেয়েই বের হয়েছিল। নামাজ পড়ে তার ভাত আর খাওয়া হলো না।’
ঘরবন্দি জীবন কাটছে কেনানের
ঘর থেকে বের হতে পারেন না বিস্ফোরণে আহত মো. কেনান। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে ফ্যানের বাতাসের নিচে থাকতে হয়। ঘর থেকে বের হলেই সারা শরীর জ্বালাপোড়া করে। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে তার দিন কাটছে অনেক কষ্টে।
কেনান বলেন, ‘এখন আর আমি কোন কাজ করতে পারছি না। আমার বাবাও তেমন কাজ করতে পারেন না। আমার স্ত্রী সন্তান রয়েছে। তাদের খরচ যোগাতে পারছি না। জানি না আমার দিন কেমন কাটবে।’
বেড়াতে এসে লাশ হয়ে ফেরেন ফরিদ
প্রথম নানা নানা হওয়ার আনন্দে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকা থেকে ছুটে এসেছিলেন মেয়ের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ইচ্ছা ছিল নাতি ও মেয়েকে পরের দিন আবার ময়মনসিংহ ফিরে যাবেন। বাড়ি ঠিকই গিয়েছেন কিন্ত ১৫ দিন পরে। জীবিত নয় লাশ হয়ে।
ফরিদের মেয়ে খাদিজা বলেন, ‘স্বামীর চাকরিসূত্রে আমি নারায়ণগঞ্জেই বসবাস করতাম। আমার সন্তান জন্মের খবরে বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিলেন বাবা। কিন্তু এই আসাই তার শেষ আসা হবে তা জানা ছিল না।’
স্বপ্ন স্বপ্নই থেকেই গেলো পারুল বিবির
পারুল বিবির স্বামী অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন অনেক আগেই। তিন ছেলেকে নিয়ে কোনরকম সংসার কেটে যাচ্ছিল তার। স্বপ্ন ছিল একদিন তার ছেলেরা বড় হয়ে লেখাপড়া করে চাকরি করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না পারুল বিবির। তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় হারান দুই ছেলেকে। সারাঘর জুড়েই তার দুই ছেলের স্মৃতি।
পারুল বিবি বলেন, ‘আমার ছেলেরা সংসারের চেহারা পরিবর্তন করার স্বপ্ন দেখাতো আমাকে। আজ আমার দুই ছেলে নেই। ছোট ছেলেটিকে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি।’
বাবাকে হারান সুমন বেপরী
মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় এক মিনিটের ব্যবধানে বেঁচে গিয়েছিলেন সুমন বেপারী। সেদিনের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে সুমন বেপরী বলেন, ‘আমি প্রায় সময়ই ওই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতাম। আমার বাবার বয়স হয়ে যাওয়ায় তিনি সবসময় বাসায়ই থাকতেন। পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মসজিদে গিয়ে আদায় করতেন। এদিন আমি বাবার সাথে মসজিদে গিয়ে এশার নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষে আমি বের হয়ে আসি কিন্তু বাবা প্রতিদিনের মতোই একটু দেরি করে বের হচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। আমি বের হওয়ার এক মিনিট পরই বিকট শব্দ শুনি। লোকজন বলাবলি করতে থাকে মসজিদে আগুন লাগছে। মসজিদের ভেতরে গিয়ে দেখি আমার বাবার সমস্ত শরীর পুড়ে গেছে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আমার বাবা। এক মিনিট পর বের হলে আমিও আর জীবিত থাকতাম না।’
নতুন করে নির্মাণ করা হবে সেই মসজিদ
নিরাপত্তার স্বার্থে পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদটি ভেঙে আবার নতুন করে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই মসজিদ ভাঙ্গার কাজ শুরু হবে। পাশাপাশি নতুন মসজিদের কাজও শুরু হবে বলে জানিয়েছেন মসজিদ কমিটির নেতারা।
মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর বলেন, ‘আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে তল্লা মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি পেয়েছি। কিন্তু মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে তা পূরণ করতে হরে মসজিদ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। তাই মসজিদটি নতুন করে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
গত ২৯ আগস্ট কয়েক দফা শর্তের ভিত্তিতে কিছু শর্তের ভিত্তিতে মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। অনুমতি পাওয়ার পর নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে মসজিদ কমিটি ও এলাকাবাসী মিলে মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মসজিদ নতুন করে নির্মাণের পর সেখানে নামাজ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দগ্ধ অবস্থায় ৩৭ জনকে জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৪ জনই মারা যান।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন