সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক, গণমাধ্যম আমাদের জীবন-ধারার উপর কতটা বিশেষ ভূমিকা রাখে তা সবার জানা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশে নামে বেনামে ভিত্তিহীন ডটকম আর ডটনেট ওয়েব সাইট খুলে সাংবাদিক এবং সম্পাদনায় নিজেকে জড়িয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছেন! সাধারণ মানুষও তাই মনে করছে যে হয়ত তিনি সাংবাদিক। তবে সাম্প্রতিক-কালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অঙ্গনে অদক্ষ-অপেশাদার-ভূইফোঁড় কথিত সাংবাদিকদের আনা-গোনা বেড়ে যাওয়ায় চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে এ সেক্টরে। মূর্খ আর অশিক্ষিত মানুষদের ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দেয়াটা একটি লক্ষণ মাত্র, এটি হচ্ছে- দক্ষ ও শিক্ষিত সাংবাদিকদের অদক্ষতার ফসল।
এসব অদক্ষ অযোগ্য অশিক্ষিত গন্ডমুর্খ লোকেরা সাংবাদিকতার মহান পেশাকে কলুষিত করে জাতির যে ভয়াবহ ক্ষতি করে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা না হলে তা দিন দিন আরও ভয়াবহ আকার ধারন করবে সন্দেহ নেই। এর আরও বহু কারণ রয়েছে। একজন সাংবাদিক আরেক জনকে ঘায়েল করতে মূর্খদের দলে টেনে দল ভারী করে।
মূর্খদের দলে টেনে শিষ্য বানিয়ে নিজেকে গুরু হিসেবে জাহির করে। আবার অনেক সম্পাদক যে কাউকে যোগ্যতা যাচাই না করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শুধু মাত্র পত্রিকার একটি আইডি কার্ড প্রদান করে এবং বাৎসরিক রিনিউ করাতে আবার টাকা নিয়ে থাকে। আর সেই কার্ড ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহের নামে সাধারন মানুষে কাছ থেকে এক ধরনের চাঁদাবাজি করে।
আর তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া টা একটু ভিন্ন ধরনের, প্রতিটি জেলায় দুই থেকে চারজনও প্রতিনিধি নিয়োগ দিচ্ছে। উপজেলা এবং থানা প্রতিনিধি তো আছেই। আবার প্রতিনিধি আরো বাড়ানোর জন্য জেলা প্রতিনিধি (উত্তর), জেলা প্রতিনিধি (দক্ষিণ), পূর্ব- পশ্চিম। আবার উপ-জেলা প্রতিনিধি (উত্তর কোণ), উপজেলা প্রতিনিধি (দক্ষিণ কোণ) প্রতিটি কোণায় কোণায় সাংবাদিক। কি লাভ এসব করে সাংবাদিকতার নূন্যতম জ্ঞানটাও এদের নেই। অনেকের আবার নেই কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত লজিস্টিকস নেই। এদের মধ্যে অনেকে আবার বিনা বেতনে ফ্রি মেহনত করতে পারে।
সে ধরনের প্রস্তাবে অনেক অযোগ্যরা দারুন খুশি হয়ে শুধুমাত্র একটি কার্ডের জন্য এবং সাংবাদিক লেভেল লাগিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সুযোগ সুবিধা ভোগ করার জন্যই এসব প্রস্তাবে রাজি হয়ে নিজের পকেটের পয়সা খরছ করে ফ্রি মেহনতে আত্মনিয়োগ করেন।
এ শ্রেণীর বেশিরভাগই যে অদক্ষ অশিক্ষিত বেকার মতলববাজ দালাল টাউট কিংবা অর্ধশিক্ষিত তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আবার কেউ কেউ শখের বশে কিংবা অভিজ্ঞতা লাভের পর পরবর্তীতে ভালো একটি পত্রিকায় সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ার টার্গেট নিয়েও ফ্রি সার্ভিস দিতে দেখা যায়।
সঠিক খবরের জন্য প্রয়োজন পেশাদার সাংবাদিক; ফেসবুক বন্ধু নয়, ব্লগার নয়, তথাকথিত ‘সিটিজেন জার্নালিস্ট’ নয়, এমনকি ‘ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক’ও নয়। এসব তথাকথিত সাংবাদিকেরা নিজে সংবাদ লিখতে না পেরে অন্যের কাছ থেকে ধার করে সংবাদ তৈরী করে। এজন্যই দেখা যায় অধিকাংশ পত্রিকায় একই সংবাদ একই ধরনের লেখা যাতে তেমন কোন পরিবর্তন নেই, একেই বলে সিন্ডিকেট নিউজ।
আবার দেখা যায় অনেক টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা বা কলকব্জা যারা বহন করে ওদেরকেও সাংবাদিকতার এক ধরনের কার্ড দেয়া হয়। অনেক সাংবাদিক নিজেই জানেনা সাংবাদিকতার সংজ্ঞা কি! বড় বড় সমাবেশ বা মিছিল হলে তাদের ও পুলিশের সামনে দিয়ে দৌড় ঝাপ দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ক্যামেরা এপাশ ওপাশ করে ছবি তুলার কসরত করে মনে মনে ভাবে দেখো আমি কতো বড়ো সাংবাদিক।
অদক্ষ অযোগ্য অশিক্ষিত দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা তথাকথিত সাংবাদিকদের কারণেই দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা উপজেলায় সাংবাদিক ও প্রেসক্লাবের মধ্যে বিভেদ বিভ্রান্তি গ্র“পিং লবিং কাদা ছোড়াছুড়ি একাধিক ও বহুসংখ্যক প্রেসক্লাবের জন্ম।
এমত অবস্থায় সাংবাদিক মহলে প্রশ্ন উঠে তাহলে আসলেই আমাদের করণীয় কি? আমি মনে করি প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ সাংবাদিকদের সকল সংগঠনকে এক হয়ে এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা জার্নালিজম এ স্নাতক অথবা অন্য কোন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। করতে হবে সঠিক নীতিমালা ও আইন । প্রয়োজনের তখ্যমন্ত্রনালয় কর্তিৃক সাংবিধানিক নীতিমালা বাধ্যতামূলক করতে হবে প্রতিটি সংবাদ পত্র,অনলাইন পত্রিকা ও মিডিয়াতে। প্রতিটি জেলা-উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিকদেরই এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে হয়তো মফস্বল সাংবাদিকতা কোন এক সময় কুলি, দিনমজুর, গরুর দালাল, থানার দালাল, জমির দালালসহ মূর্খ আর অশিক্ষিত মানুষদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন সাংবাদিক ও সংবাদ পত্রের উপর সাধারণ গণমানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে।
লেখক- অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ও মানবাধিকার কর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন